ক্ষিপ্ত জলবায়ু: পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মানুষ
ফরিদা আখতার || Saturday 05 August 2023 ||শুষ্ক এবং তীব্র গরমের মধ্যে পার করছি বর্ষাকাল। শ্রাবণ মাসের দুই-তৃতীয়াংশ বিদায় নিচ্ছে। ঢাকার আকাশ কখনও গাঢ় কালো রং ধারণ করলেও বৃষ্টির ফোঁটা তা থেকে কমই ঝরে। গত বছরেও এমন গরম আবহাওয়া ছিল। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতেও গরম বাড়বে– এমন আশঙ্কাই বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণতার ভয়াবহতা নিয়ে যদি কারও মনে সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে ভাবতে শুরু করুন, আমাদের জীবদ্দশায় আরও ভয়াবহ পরিণতি দেখতে হবে, যদি এখন থেকেই সক্রিয় এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার চেয়েও কি বেশি গরম? অথচ জনজীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য নেই।
জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল। শেষের দিকে (৩১ জুলাই) দুপুর ১২টার পর ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগস্টের শুরুতে আরও বেড়ে হয়েছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু ঢাকা নয়; দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা ঘরে বসেই ঘেমে-নেয়ে একাকার; বাইরে খেটে খাওয়া মানুষের কী অবস্থা, তা অনুমান করতেও ভয় পাচ্ছি। তবে আগস্ট মাসে কিছু সুখবর আছে। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসমতে, আগস্টের পুরোটা সময় সারাদেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। এমনকি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বের পার্বত্য অববাহিকার কিছু স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
তীব্র তাপদাহের বিষয়টা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই ঘটছে। চলতি বছরে বিশ্বজুড়ে খরা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এল নিনো ফিরেছে। এর ফলে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং গরম বাড়ছে। এটা এল নিনোর সাধারণ লক্ষণ। স্প্যানিশ শব্দ এল নিনো (যার অর্থ ছোট বালক) এখন আবহাওয়ার এই বিশেষ প্রকৃতি বোঝাতে পৃথিবীজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এল নিনো হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এই স্রোতের ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল উষ্ণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে পেরুর দিকের পানি। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধের পুবালি বায়ুর প্রবাহ বদলে যায়। পুবালি বায়ু যখন পশ্চিমে বয়ে যায়, তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার– এই পুরো অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। বাতাসের প্রবাহ সমুদ্রস্রোতকে বয়ে নিতে থাকে পশ্চিম দিকে। ফলে পশ্চিমের দিকে বৃষ্টি বাড়ে। আর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত– এসব অঞ্চলে দেখা দেয় বৃষ্টির অভাব। বেড়ে যায় তাপমাত্রা। এমনকি খরাও দেখা দিতে পারে। এসব লক্ষণই বাংলাদেশে বিদ্যমান।
বিশ্বজুড়ে এল নিনো ফিরেছে এবং সে কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)। আগামী বছরেও তা বাড়বে। এই বার্তা আমাদের জন্য ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন বিষয়টি জলবায়ু পরিবর্তনের আলোকে দেখছে এবং আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য দুবাইয়ে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনের (কপ-২৮) প্রসঙ্গ টানছে। ইউরোপীয় সংগঠন কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সংক্ষেপে C3S) জানায়, কিছুদিন ধরে ভূপৃষ্ঠে বায়ুর তাপমাত্রা শিল্প যুগের আগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রয়েছে। যদিও এর আগে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করেছিল, তবে উত্তর গোলার্ধে এমনটা হয়নি। সেখানে গত ১ জুন থেকে গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েছে। এর আগে এপ্রিল ও মে মাসে সাগরের তাপমাত্রা আগের রেকর্ড ভেঙেছিল।
তাপদাহের কারণে কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের তীব্র দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপের ইতালি, গ্রিস, আলজেরিয়া, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড এবং তিউনিসিয়ায় ভয়াবহ দাবানল সংঘটিত হয়েছে। মানুষ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত ১ লাখ ২০ হাজার বছরে এমন গরম মাস আর হয়নি। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘This isn’t global warming anymore; it’s global boiling’; এত দিন বৈশ্বিক উষ্ণতার কথা বলা হয়েছে, এখন সেটা আর নেই। এখন বিশ্ব সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বে এশিয়া মহাদেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ আক্রান্ত। এর আয়তন অনেক বড় এবং বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপ এখানে। কাজেই বাংলাদেশে আমরা গরমে মরব; অন্যদিকে খরা, বন্যা ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে বাড়ছে রোগবালাই।
এদিকে ঘরে ঘরে জ্বর, কাশি, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি নিয়ে মানুষ ভুগছে। কভিডের মতো মহামারি আখ্যায়িত করা না হলেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোনো অংশে কম নয়। দু’তিন দিন জ্বর থাকলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হচ্ছে। যাদের ডেঙ্গু নেগেটিভ হচ্ছে তাদের জ্বর কিন্তু ছাড়ে না; কাশিও লেগে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে রক্তের প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যায়। ডেঙ্গু নয় জেনে স্বস্তি পেলেও এই জ্বরের কারণ এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে তো ভোগান্তির অন্ত নেই। হাসপাতালেও এখন জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য (১ আগস্ট, ২০২৩), জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৪১৬; মৃতের সংখ্যা ২৬১। সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে জুলাই মাসে; ৪৩ হাজার ৮৫৪ এবং মৃত ২০৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, যদিও ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত অক্টোবর মাসেই ডেঙ্গুর মৌসুম বা পিক সিজন বলে ধরা হয়। তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, এটা আমরা জানি। একই সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জনস্বাস্থ্যের জন্য নানা রকম ঝুঁকির সৃষ্টি হয়– জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তা-ই মনে করেন। কিন্তু এ বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এল নিনোর প্রভাব এবং এর সঙ্গে ভেক্টর-বাহিত রোগের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এল নিনোর মতো পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, এমন গবেষণা হয়নি। এখানে মশার চরিত্র বদলাচ্ছে কিনা; এডিস মশা দিনে কামড়ালে ডেঙ্গু হয় নাকি রাতে; এডিসের লার্ভা কি স্বচ্ছ পানিতে হয় নাকি এখন ময়লা পানিতেও পাওয়া যাচ্ছে– এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের চিন্তার অন্ত নেই।
অন্যান্য দেশ যেমন ইন্দোনেশিয়া, কলাম্বিয়া, সুরিনাম ইত্যাদি দেশে যেখানে বাংলাদেশের মতোই আবহাওয়া, সেখানে গবেষণা হয়েছে এবং আবহাওয়ার চরম অবস্থার সঙ্গে ভেক্টর-বাহিত রোগের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান দিয়ে এবং হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। রোগতত্ত্ব বিভাগও তাপমাত্রার সঙ্গে ডেঙ্গুর সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়ে তথ্য দেয়নি। সিটি করপোরেশন বিভিন্ন এলাকায় মশার লার্ভা পাওয়া যায় কিনা অভিযান চালিয়ে এবং জরিমানা করেই খালাস। মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে মশার প্রজননও বেড়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে সবকিছুকে খণ্ড খণ্ডভাবে দেখার প্রবণতা দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়া দপ্তরের বিষয়। এর সঙ্গে কৃষির সম্পর্কটা অস্বীকার করা যায় না বলে ফসলের ক্ষতির কথা আসে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ করে তাপমাত্রার এই উর্ধ্বগতির সঙ্গে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ গাছ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে; উন্নয়নের কাজগুলো পরিবেশসম্মত হচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য সমস্যায় ব্যাপক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত। কভিডের মতো ডেঙ্গুও ধনী-গরিব বাছবিচার করে না। শুধু পার্থক্য এই; ধনীর মশারি আছে, গরিবের নেই। হাসপাতালে এখন আহাজারি।
আসুন, জলবায়ু পরিবর্তন বা জলবায়ু দুর্যোগকে গুরুত্ব দিই। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষি, জনস্বাস্থ্য সব কিছু নিয়ে মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করি। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী দেশগুলোকে ভুক্তভোগী হিসেবে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাধ্য করতে হবে। আমাদের নিজেদের দেশেও কার্বন নিঃসরণের কারণগুলো যথাসাধ্য দূর করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনে গিয়ে ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে ‘ভিক্ষা চাওয়া’ আমাদের কাজ নয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি (সমকাল) ৪ আগষ্ট ২০২৩ তারিখে 'ক্ষিপ্ত জলবায়ু: পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মানুষ' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
ফরিদা আখতার: সভানেত্রী, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা